সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা কর।

সংখ্যালঘুর প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা কর।

ভূমিকা: পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই কমবেশি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। সংখ্যালঘু বলতে এমন একটি গোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যারা ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভিন্ন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর তুলনায় সংখ্যায় কম, কম ক্ষমতাশালী বা কম প্রভাবশালী। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর একটি সর্বজনীন সংজ্ঞা না থাকলেও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও প্রেক্ষাপটে তাদের চিহ্নিত করা হয়।
সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা কর।


সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রকৃতি ও পরিধি

নিম্নে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রকৃতি/বৈশিষ্ট্য ও পরিধি উল্লেখ করা হলো-

১. জনসংখ্যায় কম: সাধারণত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ সংখ্যায় কম, কারণ সংখ্যালঘুকে জনসংখ্যার অনুপাতে বিবেচনা করা হয়। এরা বৃহৎ বা প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর দ্বারা সংখ্যালঘু বলে বিবেচিত হয়।

২. সামাজিক দুরত্ব: সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে। ফলে একে অপরের প্রতি অনেক সময় অবিশ্বাস ও বিরোধপূর্ণ মনোভাব পোষন করে।

৩. স্বার্থ উপেক্ষিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্বার্থ সবসময় রক্ষিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্বার্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা উপেক্ষিত হয়ে থাকে।

৪. সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত মনে করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সকল সুবিধা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ন্যায় পেয়ে থাকলেও নিজেদের অবহেলিত, নিকৃষ্ট বা হেয় প্রতিপন্ন মনে করে।

৫. আর্থসামাজিক মর্যাদা সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর অনেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর তুলনায় নিজেদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট মনে করে আর এর বিপরীত অর্থাৎ সংখ্যালঘুরাও নিজেদের অন্যদের তুলনায় উৎকৃষ্ট মনে করতে পারে।

৬. ভৌগোলিক অবস্থান: সংখ্যালঘু ধারণাটি কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ, একদেশে যারা সংখ্যালঘু অন্য দেশে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইউরোপের শ্বেতকায় নরগোষ্ঠীর লোক কৃষ্ণকায় ও মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করে। এসব দেশে শ্বেতকায় সংখ্যালঘুরা নিজেদেরকে উৎকৃষ্ট নরগোষ্ঠী ও উৎকৃষ্ট সংস্কৃতির অধিকারী বলে দাবি করে।

৭. অন্যান্য গোষ্ঠীর দ্বারা শোষণ: সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা অন্যান্য গোষ্ঠীর দ্বারা নানাভাষে শোষিত এবং লাঞ্ছিত হয়। ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদাবোধের দিক থেকে সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সংখ্যালঘুদের দুর্বলতা ও অসুবিধাজনক অবস্থাগুলোই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সুবিধাজনক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সমাজে নিম্ন মর্যাদা প্রসাদ করার মাধ্যমে প্রভাবশালীরা সংখ্যালঘুদের শোষণ করে। শোষণ করে সংখ্যালঘুদের শ্রম এবং সম্পদকে। সংখ্যালঘুদের সদস্যরা যে কেবল প্রভাবশালীদের দ্বারা বঞ্চিতই হয় তাই নয়- সংখ্যালঘুরা প্রামাই প্রভাবশালীদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাষ ও বিভেদমূলক আচরণের শিকার হয়। তাদেরফে অপয্যবহার করা করা হয় গালিগালাজ করা হয় এবং নানাভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে লজ্জা দেয়া হয়। এভাবে সমাজে তাদের নিকৃষ্ট করে তোলা হয়।

৮. শারীরিক ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য: সামাজিক সহসাই দৃশ্যমান এমন গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংখ্যালঘুদের চিহ্নিত করা চলে। গায়ের রং, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি বিচারে সংখ্যালঘুদের এমন একটি সমন্বিত সামাজিক একক মনে করা হয়, যা সামাজিক দিক দিয়ে একটা তাৎপর্য বহন করে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি যে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাষ প্রকাশ পায় তা গোষ্ঠীর প্রতিটা সদস্যের জন্যই প্রযোজ্য মনে করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি হিসেবে কেউ যত ভালোই হোক না কেন তাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব কমই দেওয়া হয়।

৯. আত্মসচেতন: সংখ্যালঘু গোষ্ঠী খুবই আত্মসচেতন এবং গোষ্ঠীর সবার মধ্যে একটি শক্তিশালী ঐকোর ধারণা বিদ্যমান থাকে। ইহুদি, আমেরিকান নিগ্রো বা অন্য যে-কোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ধারণা প্রবল এবং তারা একে অপরের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কে আবদ্ধ। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য সাধারণ পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়, গোষ্ঠী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে যদিও পার্থক্য থাকে, সেটা তারা স্কুলে স্বার্থ বড় করে দেখে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণভাবে যে দুঃখ কষ্ট অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়, সেটার কারণে নিজেদের পার্থক্য ভুলে গোষ্ঠীর চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা যতই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দ্বারা নির্ঘাতিত হতে থাকে ততই তাদের মধ্যকার সংহতিবোধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

১০. জন্মগত: সাধারণত কোনো মানুষ স্বোচ্ছায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য হয় না। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে জন্মলাভ করে তারা সদস্য হয়ে থাকে। সদস্যরা জন্মগত সূত্রে বা ঐতিহ্যগন্তভাবে একই বা সাধারণ পরিচয় বহন করে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কোনো সদস্যের পক্ষে স্বীয় গোত্রী ত্যাগ করা খুবই কঠিন কাজ। কেননা, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্মগতভাবে এ গোষ্ঠীর স্থায়ী সদস্য।

১১. আন্তঃগোষ্ঠীয় বিবাহ: ইচ্ছে করেই হোক অথবা প্রয়োজনের তাগিদেই হোক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সাধারণত (Endogamy) বা আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহ রীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুরা নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে পাত্র পাত্রী অনুসন্ধান করে। এবং সেখান থেকেই সাধারণত পাত্র পাত্রী নির্বাচন করে। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কোনো সদস্য সাধারণত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে বিয়ে করতে চাইবে না বা বিয়েতে অনীহা দেখাবে। কেননা, তার দৃষ্টিতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীয়া সামাজিকভাবে নীচু অর্থাযার অধিকারী এবং তারা নানাভাবে অবহেলিত, নির্যাতিত এবং বঞ্চিত। অন্যদিকে সংখ্যালঘুরা নানাদিক বিবেচনায় সাধারণত নিজ গোজীতেই পাত্র-পাত্রী অনুসন্ধান করে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে Consciousness of kind বা গোষ্ঠীর চেতনাই বেশি কাজ করে। এর ফলে যা দাঁড়ায় তা হলো সংখ্যালঘু সমাজে বংশ পরস্পরায় সংখ্যালঘু মর্যাদা (Minority status) বর্তাতেই থাকে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মর্যাদা তাদের সদস্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করে না; বরং তাদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, জাতিগত বা আর্থসামাজিক স্বাতন্ত্র্যই সংখ্যালঘু পরিচয়ের ভিত্তি। একটি সমাজে কেউ সংখ্যাগতভাবে অধিক হলেও সামাজিক ক্ষমতায় সংখ্যালঘু হতে পারে। যেমন আফ্রিকার বুরুন্ডি দেশে সংখ্যায় কম হলেও তুতসি জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুদের শাসন করেছে।

সুতরাং, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রকৃতি নির্ধারিত হয় তাদের সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতা, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও গোষ্ঠীগত চেতনার ভিত্তিতে। এদের যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা একটি ন্যায়ভিত্তিক, সাম্যবাদী সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত।

No comments:

Post a Comment